
অতনু রায়
ভাষা এক হলে প্রেম তাড়াতাড়ি হয় কিনা জানা নেই, তবে দুই বাংলাতেই শিল্পীদের প্রেমে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি পড়েন। জয়া, জ্যোতি, বাঁধন, ফারিনের পর এবার গঙ্গাপাড়ে কাজী নওশাবা আহমেদ। আজ মুক্তি পাচ্ছে অনীক দত্ত পরিচালিত এবং ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন প্রযোজিত ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’। তার আগে নওশাবার সঙ্গে ফোনেই আড্ডা জমল।
প্রশ্ন: বাঙালি অভিনেত্রী। তবুও এতদিন পর বাংলাতেই নামের সঙ্গে ‘প্রথম ছবি’ জুড়ে গেল। এই অনুভূতি কেমন?
নওশাবা: প্রথম প্রেমের মতো। প্রথম সন্তানের মতো। প্রথম মঞ্চের মতো। খুবই ভাল অনুভূতি। আমার কাছে ব্যাপারটা সত্যিই উৎসবের মতো।
প্রশ্ন: দুই বাংলায় কাজ করে কতটা ফারাক মনে হল?
নওশাবা: ফারাক তো হবেই। প্রথম কারণ, কলকাতার ইন্ডাস্ট্রির বয়স অনেক বেশি। তুলনায় বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রি অনেক নবীন। আমাদের এখন নতুন প্রজন্মের সময় এসেছে। তারা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সবদিক থেকে। ফর্মুলার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে তারা নতুন গল্প বলার চেষ্টা করছে। কলকাতাতেও আমি আমার ৪৫ দিনের শুটিংয়ে দেখেছি অনেকেই নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন। কস্টিউম ডিজাইনার হোক বা সিনেমাটোগ্রাফার, তারা এখন পৃথিবীর বাজারটা নিয়ে ভাবেন। শুধুমাত্র কলকাতা এবং বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নয়। আমাদের দেশের নবীন প্রজন্মও কিন্তু পৃথিবীর বাজার নিয়ে ভাবেন। এটা কিন্তু খুব আশার কথা। কারণ, শিল্পী তো আর কোনো বেড়াজালে আটকে থাকতে পারে না! আমার খুব গর্ব হয় যে আমরা একটা দুর্দান্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যখন আমাদের পৃথিবী জোড়া দর্শক। যে কাজটা আমি কলকাতায় বা বাংলাদেশে বসে করছি সেই কাজটা দিয়ে হয়ত আফ্রিকাতেও কাউকে ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব। এটা ভাবতেই আমার দারুণ লাগে।
প্রশ্ন: নাটকের মঞ্চ অভিনেত্রী নওশাবাকে কতটা পরিণত করেছে?
নওশাবা: আমার শুরুটা আসলে উল্টো। মানুষের শুরু হয় হয় সিনেমা থেকে নয় মঞ্চ থেকে। আমার শুরু পাপেট্রি থেকে। ভারতে যেমন ‘গলি গলি সিম সিম’ ছিল, আমাদের সেরকম সিসিমপুর। সেখানে ইকড়ি মিকড়ি নামে একটা তিন বছরের বাচ্চার চরিত্রে কন্ঠ দিতাম আর পুতুল পরিচালনা করতাম। পাপেটের পরে টিভিসি, টিভি নাটক, সিনেমা…তার পরে আমি মঞ্চে যোগ দিয়েছি। শুরুটা কন্ঠ অভিনয় দিয়ে, তারপরে আস্তে আস্তে শারীরিক এবং আত্মিক অভিনয়। মঞ্চে এসে আমার মনে হয়েছে, মঞ্চ মানুষকে গ্রাউন্ডেড করে। মিডিয়ার স্পটলাইট বিভিন্ন ভাবে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিতেই পারে। মঞ্চ সবসময় মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসে, শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ রাখে। তুমি যাই হয়ে ওঠো, তার পেছনে প্রচুর মানুষের অবদান, শ্রম, প্রেম রয়েছে এটা মঞ্চ মনে করায়। তাই যখন আমি অন্য কোন কাজ করতে পারিনি তখনও শুধু থিয়েটার করেছি। আমার সব সময় মনে হয়, থিয়েটারের মানুষদের মধ্যে বোধ ব্যাপারটা খুব জাগ্রত। তারা দেশ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে ভাবে এবং সেই সব বিষয় নিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করে, কথা বলে। থিয়েটার আমাকে ঋদ্ধ করে। আমি আসলে আদরের কাঙাল আর পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ। থিয়েটারের নিজস্ব পরিবার রয়েছে। মানুষগুলোকে আমি কত বছর ধরে দেখছি! তাদের সুখ দুঃখে আছি, তারাও আমার সঙ্গে থাকছে… এটা একটা আলাদা অনুভূতি।

প্রশ্ন: কেরিয়ারের ইঁদুর দৌড়ে তুমি সেভাবে নাম লেখাওনি। এটা কি ইচ্ছাকৃত?
নওশাবা: আমি আসলে এই বিষয়টাতে বিশ্বাসই করি না। এইগুলো আমার কাছে তৈরি করা বিষয়। ইঁদুর দৌড় নয়, অনেকটা ইঁদুর ফাঁদ বলা যায়। এসব করে সুস্থ প্রতিযোগিতাকে অসুস্থ করে তোলা, এবং মানুষকে অতিরিক্ত চাপে রাখা হয়। আমি বিশ্বাস করি, আমার যেটা প্রাপ্য আমি সেটাই পাব। কেউ শত চেষ্টা করেও সেটা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমি যে কাজটা করছি, সেটা যথেষ্ট সততার সঙ্গে করব। সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিতভাবেই থাকা প্রয়োজন, তবেই মানুষের কাজে উন্নতি হয়। কিন্তু এই ইঁদুর ফাঁদের মধ্যে আমি মোটেই নেই। আমি বিশ্বাসও করি না, আমার দ্বারা হবেও না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। সেন্সর বিষয়ে একজন অভিনেতার অ্যাপ্রোচ অন্যদের থেকে কতটা আলাদা হয়?
নওশাবা: খুবই আলাদা হয়। এখানে বাকি যাঁরা আছেন তাঁরা চলচ্চিত্র-বোদ্ধা, আমি চলচ্চিত্র-প্রেমী। আমি তো একেবারেই সিনেমার প্রেমে আছি। যাকে বলে, ‘আই ডোন্ট ফল, আই রাইজ ইন লভ্ ফর সিনেমা’। সিনেমা করার জন্য আমি দাঁত কামড়ে পড়েছিলাম। সার্টিফিকেশন বোর্ডটা আমার কাছে সেরকমই একটা জায়গা যেখানে আমি আমার মিডিয়ার কলিগদের কাজ দেখছি এবং সেটা থেকে অনেক কিছু শিখছি। আমি চেষ্টা করি একজন অভিনেত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখতে। তারপরে অবশ্যই সৃজনশীলতা আর মূল্যবোধের বিভিন্ন বিষয়গুলোকে নজরে রেখেই দেখা হয়। আর এখনও যেহেতু সেরকম কোনও বিধিমালা তৈরি হয়নি তাই বলা যায় আমরা একটা ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই এখনো একটা লার্নিং প্রসেস। সিনিয়রদের সঙ্গে কোনও একটা ছবি দেখতে দেখতে, অভিনেত্রী এবং শিল্পী হিসেবেও একটা ছবিকে অন্যভাবে দেখাটা শুরু হয়েছে। এইটা আমি খুব এনজয় করছি এবং শিখছি। তাই বলি, ‘লং ওয়ে টু গো, বিফোর আই স্লিপ’।
প্রশ্ন: ওটিটি এসে কন্টেন্টের মানকে কতটা প্রভাবিত করেছে?
নওশাবা: ওটিটি আসার পরে মানুষ অনেক স্বাধীনভাবে ভাবতে পারছে। আগে একটা নির্দিষ্ট ফর্মুলার মধ্যেই ভাবতে হত। সেটা থেকে বেরোনোর ফলে নতুন নতুন ফরম্যাট, জঁরের জন্ম হচ্ছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, বিভিন্ন ভাষা এবং সংস্কৃতির মেলবন্ধন হচ্ছে। আগে শুধুমাত্র ফেস ভ্যাল্যু আর স্টারডমের উপর নির্ভর করে ইন্ডাস্ট্রি চলত। সেটা বদলেছে। এখন ভাল অভিনেতা বা অন্যান্য বিভাগের শিল্পীমনা মানুষেরা একটা খুব সুস্থির আর দারুণ প্র্যাকটিসের জায়গা পেয়েছেন। সর্বোপরি, সিনেমাকে একদম আমাদের কাছে আনছে। ফলে মানুষ আরও সিনেমা বানাতে চাইছে, বানানোর সাহস করছে। এটাই তো হওয়া উচিত। আগে সিনেমা খুব দূরের বিষয় ছিল, এখন আর তা নয়। আমরা চাইলে একটা ফোন দিয়েও সিনেমা বানাতে পারি। এবার এটাও দেখতে হবে সেটা করতে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই যেন না হয়। শেখার জন্য অনেক সময় অনেক কিছুই বানানোর প্রয়োজন পড়ে কিন্তু সেটার যাতে মানের দিকটা ঠিক থাকে সেটাও দেখতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ ওটিটি বাড়িতে বসে দেখে। তাই শুধুমাত্র ক্রাইম থ্রিলার না বানিয়ে একটু মানসিক শান্তির দিকে নজর দিয়ে কিছু কনটেন্ট তৈরিও খুব জরুরী। কারণ, পৃথিবী জুড়েই মানুষ এখন রুদ্ধশ্বাসের মধ্যে দিয়ে সময় কাটায়। সেখানে একটা ছোট স্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে তাদের যদি একটু পজিটিভিটি, একটু মানসিক শান্তি দিই তাহলেই আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে আরও একটু শান্তি আসতে পারে।
প্রশ্ন: শিল্পীর পেশা অনিশ্চিত। মা নওশাবা চান তাঁর সন্তান পেশাদার শিল্পী হোক?
নওশাবা: দেখুন, আমি বলব সমস্ত কিছুই অনিশ্চিত। এটা ওর জীবন। যেটা করে ও আনন্দ পাবে, যাতে ওর মনে হবে যে এই কাজটা না করলেই নয়, করবে। যেমন আমার কোনও কিছু সৃষ্টি না করতে পারলে দমবন্ধ হয়ে আসে। তাই যখন আমি সিনেমায় বা নাটকে অভিনয় করতে পারিনি তখন আমি মঞ্চে গেছি। মঞ্চে যখন অভিনয় করতে পারিনি তখন আমি নির্দেশনায় গেছি। কোনো না কোনোভাবে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে থাকতে না পারলে আমার মনে হয় আমি মারা যাব। এই বিষয়টা যদি ওর থাকে, তাহলে সেটা কেন নয়? যেমন, এখনই ও থিয়েটারটা করে। অনেক ছোটবেলা থেকেই আমি ওকে থিয়েটারটা করাই। আমার থিয়েটারেও ও একটা বড় রোল প্লে করে। ছোট বয়সে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে সে আমাকে অ্যাসিস্ট করে। ওর ভীষণ পছন্দের জায়গা হচ্ছে থিয়েটার। আমার কাজ হচ্ছে ওকে রাস্তাটা সহজ ভাবে দেখিয়ে দেওয়া যাতে ওর পথটা চলতে সুবিধা হয়। আমার ওর উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার কোনও অধিকার নেই।

প্রশ্ন: আপনার শিকড় তো এই বাংলায়। শেষ কবে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল?
নওশাবা: আমার বাবার জন্ম হুগলিতে। তারপরে ওঁরা চলে এসেছিলেন খুলনাতে। আমার মায়ের বাড়ি মুর্শিদাবাদে, তারপর চলে এসেছিলেন ঢাকাতে। আমার সব জায়গায় যাওয়া হয়নি। কলকাতায় গেছি। হুগলিটা ক্রস করেছি। শান্তিনিকেতনে গেছি। দিল্লি, আগ্রা, ইউপি, সিমলা, দার্জিলিং এইসব জায়গায় যাওয়া হয়েছে। হুগলিটা আমার যাওয়া হয়নি। খুব ইচ্ছে ছিল বাবাকে নিয়ে যাব। বাবাও নিয়ে যাবে নিয়ে যাবে বলে নিজেই চলে গেলেন। তবে কোনো না কোনো সময়ে তো যাবই।
প্রশ্ন: কলকাতার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। রাতের ঢাকার শরীরে কখনও একটুও কলকাতার গন্ধ পান? দুই শহরের প্রেম কতটা তীব্র?
নওশাবা: প্রেমটা ভীষণ তীব্র। এটা বলার জন্য বলা নয়। আমি যখন রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে “এখন অনেক রাত…তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস” গুনগুন করি, তখন সুরে সুরে কোথাও গিয়ে কলকাতা আমার ঢাকার সাথে মিশে যায়। কলকাতায় যখন শুটিং করে ফিরতাম, রাস্তার কুকুরগুলো দৌড়ে এসে আমাকে আদর করত। অনেক সময় আমি ওদের সঙ্গেই বসে বসে গল্প করেছি। আমি ঘুরে বেড়াতাম, ভোর বেলায় হাঁটতে বের হতাম…যারা সবজি বিক্রি করতে আসতেন, দেখতাম। কলকাতার যে কফিশপগুলো আছে, সেখানে বসে স্ক্রিপ্ট পড়তাম। এখন এখানেও ফাঁকা কফিশপে বসে কলকাতায় কাটানো সময়ের কথা মনে পড়ে। প্রেমটা আসলেই ভীষণ তীব্র। শারীরিকভাবে হয়ত আমি এখন সেখানে নেই, হয়ত অন্য রকমের একটা সময় আমরা কাটাচ্ছি – কিন্তু আমার মনে হয় প্রেম কখনওই হেরে যায় না। শিল্পীদের প্রেম, গান, ওখানকার যামিনী রায়, এখানে জয়নুল আবেদিন, এসএম সুলতান। রবি ঠাকুর – নজরুল সবমিলিয়ে এ এক শাশ্বত প্রেম। বাঙালি আজও প্রেম বললেই উত্তম-সুচিত্রা জুটি বোঝে। এই দুই শহরের প্রেমটাও উত্তম-সুচিত্রার মতো! কোনও কিছুর বিনিময়েই সেটা নষ্ট করা যাবে না। আমি বিশ্বাস করি, আমরা শিল্পীরা যদি জাগ্রত থাকি তাহলে এই প্রেমটাও জাগ্রত থাকবে।