
অতনু রায়
রোহিত সেন হোক বা চন্দন চ্যাটার্জী। বিহারী হোক বা ফেলুদা। তাঁর উপস্থিতি মানেই স্মার্টনেস, সপ্রতিভ চোখ আর একরাশ পজিটিভিটি। ছোটপর্দা, বড়পর্দা বা ওটিটি, তাঁকে দেখার জন্য মানুষের অপেক্ষা, যত দিন গেছে, বেড়েছে। শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন প্রযোজিত প্রতিম দাশগুপ্ত’র ‘চালচিত্র‘। প্রধান চরিত্র কনিষ্ক চট্টোপাধ্যায় রূপে তিনি। হাজার ব্যস্ততার মাঝখানে সময় বার করে বললেন অনেক কথা। এবারের ‘রোববার কথা‘য় টোটা রায়চৌধুরী।
প্রশ্ন: তোমার দুটো কাজ একসঙ্গে মুক্তি পেল। দুটোরই প্রধান ভূমিকায় তুমি। ‘চালচিত্র’ ছবিতে তোমার যে চরিত্র সেটা পুলিশের এবং পরিচালক বলছেন তাঁকে ঘিরে প্রশ্নের অবকাশ আছে। ব্যক্তি টোটা রায়চৌধুরীকে অনেকেই আদর্শ মনে করেন। কিন্তু এটা একেবারেই অন্যরকম একটা চরিত্র। চরিত্রটা রিলেটেবল্ করার জন্য কোনও আলাদা প্রস্তুতি থাকে?
টোটা: এই প্রসেস নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু আমি একটা কথাই বলব, যেটা অন্তত আমার ক্ষেত্রে সত্যি, আমি মূলত আমার পরিচালকের উপর নির্ভর করি। আমার কাজ হচ্ছে, উনি কী চাইছেন আর কী বলছেন সেটা বুঝে বাস্তবায়িত করা। এটাই আমি মনে করি। এবার অনেকে আছেন যাঁরা হয়ত স্টার, তাঁদের একটা ইমেজ রয়েছে। তাঁরা সেই ইমেজ বজায় রেখে পরিচালক যেটা বলছেন সেটা চেষ্টা করেন অথবা পরিচালকও তাঁদের ইমেজটাকে মাথায় রাখেন। আমার তো সেসবের বালাই নেই!
প্রশ্ন: তুমি কি নিজেকে স্টার মনে করো না?
টোটা: না। আমি তো সেই লেভেলে কোনদিনও উঠতে পারিনি! ‘স্টার’-এর অনেকগুলো সংজ্ঞা আছে। আমার কাছে স্টারের সংজ্ঞা বা যেভাবে আমি স্টার ব্যাপারটাকে দেখি সেটা হচ্ছে, তাঁদের ছবি তাঁদের নামে চলে। আমার ছবি কিন্তু আমার নামে চলে না। আমার ছবি আমার পরিচালকের নামে চলতে পারে, আমার সহশিল্পী যাঁরা, তাঁরা যদি স্টার বা সুপারস্টার হন, তবে তাঁদের নামে চলে। আমার নামে কোনও ছবি চলে না। আমি থাকলে সেটা অনেকটা মাংসের আলুর মত। মানুষ মাংসটা খেতে যাচ্ছে, আলুটা থাকলে খুশি হয় তবে না থাকলেও কোনও অসুবিধা নেই।
প্রশ্ন: যাঁরা পড়ছেন তাঁরা অবশ্যই বুঝবেন যে এটা তোমার বিনয়। এক্ষেত্রে একটা কথা বলব, আমরা যারা সব সময় চর্চা করছি, তারা হয়ত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক, সবার কথা মাথায় রাখি। কিন্তু সাধারণ দর্শক, যাঁরা সিনেমাহলে গিয়ে ছবিটা দেখেন, তাঁদের একটা বড় অংশের কাছে এখনও এসব কিচ্ছু ম্যাটার করে না। তাঁরা দেখেন পোস্টারে কার মুখ আর গান হিট হলে, কে গেয়েছেন। আমরা দেখেছি সম্প্রতি অনেকেই ফেলুদা করেছেন। এরকমও নাম আছে, যাঁদের তুমি বলতে পার স্টার। অথচ ফেলুদা হিসেবে দর্শক গ্রহণ করলেন না। তোমাকে ভালবাসা দিলেন। কোনও একটা জায়গায় গিয়ে নিশ্চয়ই সেই ম্যাজিকটা তৈরি হচ্ছে?
টোটা: আমার নয়, সৃজিত মুখার্জির ম্যাজিক। এবং সেটা ও তৈরি করেছে। সিনেমা কিন্তু আদ্যন্ত একটা ‘ডিরেক্টর্স মিডিয়াম’। অনেকে সেটা বুঝতে চান না আবার অনেকে বুঝেও বুঝতে চান না। আমাকে কীভাবে পেশ করা হবে সেটা একেবারেই পরিচালকের ব্যাপার। কারণ, সিনেমা ‘ডিরেক্টর্স মিডিয়াম’। অভিনেতার ‘মিডিয়াম’ হচ্ছে মঞ্চ। পর্দা উঠলে, পরের দু’ঘণ্টা কী করব সেটা সম্পূর্ণ আমার উপরে নির্ভর করছে। একটা নাটকের ৫০ রজনী আমি ৫০ রকম ভাবে করতে পারি। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। কারণ, পর্দা উঠে গেলে, ‘আই অ্যাম দ্য বস্’। সেটা কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে নয়। সিনেমার ক্ষেত্রে পরিচালক বলবেন, আমার এটা চাই। হল না, কাট্। আবার হবে। চলবে, যতক্ষণ না পরিচালক বা পরিচালিকা তাঁর পছন্দের কাজটা পাচ্ছেন।সেখানে আমার স্বকীয়তার থেকেও বড় হয়ে দাঁড়ায় আমার পরিচালকের চাওয়া।

প্রশ্ন: তুমি এখন অনেক বেশি কাজ করছ, ভাল কাজ করছ। নতুন প্রজন্মের যে পরিচালক বা কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা আসছেন, তাঁদের কনফিডেন্স লেভেল কি কোনও ভাবে আগের প্রজন্মের থেকে বেশি? ব্যবসা সফল ছবি হয়ত আগে অনেক বেশি হয়েছে এবং সেসব ছবি নিয়ে আমরা এখনও আলোচনা করি। কিন্তু ছক ভাঙ্গতে চাওয়ার প্রবণতা কি এই প্রজন্মের মধ্যে বেশি? তোমার কী মনে হয়?
টোটা: যদি কনফিডেন্স বল, আমি বলব অবশ্যই। কারণ সিনেমার পরিচালক হতে গেলে যেটা সবথেকে আগে দরকার হয়, সেটা হল সাহস এবং কনফিডেন্স। এই দুটো ছাড়া কিন্তু পরিচালক হওয়া যায় না। এখন কাজের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আগে কাজে সময় বেশি পাওয়া যেত। এখন কাজের সংখ্যা বেড়েছে, বিশেষত ওটিটি আসার পরে। বলতে গেলে আমাদের জন্য একটা নতুন রাজপথ খুলে গেছে। এটা তখন ছিল না। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে, তখনকার পরিচালকেরা কিন্তু অনেক বেশি হোমওয়র্ক করে আসতেন। অনেক মনোযোগ দিয়ে লেখা হত। এই চটজলদি ব্যাপারটা তখন ছিল না। যদিও এটাই সময়ের দাবি।
প্রশ্ন: মানে অনেকটাই মেকানিক্যাল হয়ে গেছে বলতে চাইছ?
টোটা: না, মেকানিক্যাল বলব না। ডিমান্ড। এখন ডিমান্ডটাই হল, আজকে ‘কনসিভ’ করলাম, এক মাসের মধ্যে চিত্রনাট্য লিখে ফেলব, তারপরে ব্যবস্থাপনা শুরু হয়ে যাবে। তার আড়াই-তিন মাসের মধ্যে শুটে চলে যাব। শুটিং শেষ করব, পোস্ট-প্রডাকশন করে পাঁচ থেকে ছ’মাসের মধ্যে পুরো ছবি রেডি। এখন এরকম স্পিডেই সাধারণত কাজ হয়। ওটিটিতে তো বটেই, সিনেমাও এখন এইভাবে কাজ হয়। সেটা একদিক থেকে আবার ভালও। এটা আমারও মনে হয়, লুচি একেবারে গরম ভাজা পরিবেশন করলে সেটা অনেকটাই সুস্বাদু লাগে। কিন্তু আবার অসুবিধাও একটা আছে। সেটা হচ্ছে, ওই যে বলে না, ভিজিয়ে রাখা! চেতনায়, শয়নে, স্বপনে, নিশি জাগরণে! একটা ভাবনা এল। ভাবনাটাকে বেশ কিছুদিন ফেলে রাখা। তারপর একের পর এক ড্রাফ্টের মাধ্যমে সেটা পরিশিলিত, পরিমার্জিত হচ্ছে। ‘রাফ এজ’ বাদ গিয়ে ‘ওয়েল রাউন্ড’ করা হচ্ছে। সেই সময়টা আর পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন: স্পিডের কথা হল বলে বলছি। স্পিডের সঙ্গে অভিযোজিত হবার ব্যাপারও তো থাকে। তোমার মত যাঁরা ভাল অভিনেতা তাঁরা হয়ত অল্প সময়ে ‘শট ওকে’ করতে পারেন। কিন্তু এমনও অনেকে আছেন যাঁদের একাধিক টেকের প্রয়োজন। সেই সময় তো তাঁরাও পাবেন না। তাহলে সময়ের চক্রে তাঁরা কি ‘ইরেলিভ্যান্ট’ হয়ে যাবেন?
টোটা: যারা ‘অ্যাডাপ্ট’ করতে পারবে না, তারা ‘ইরেলিভ্যান্ট’ হয়ে যাবে। এটা সময় বলছে। এটা ইতিহাস বলছে। তুমি যদি মানিয়ে নিতে না পার, তুমি কোনও ক্ষেত্রেই ‘সার্ভাইভ’ করতে পারবে না। আমরা এমন একটা সময় থেকে কাজ করে আসছি, যখন বলা যেত আরেকটা টেক বা দুটো টেক করব। বলা যেত, আমাকে আর একটু সময় দেবেন আমি রিহার্সাল করব। সেই সময়টা কিন্তু আমরা পেতাম। আজকে যাঁরা কাজ করছেন বা আমাদের প্রজন্মের যাঁরা আজকেও কাজ করছেন, সেই সময়টা পাচ্ছেন না। এখন হল, এটা এখনই করতে হবে, আজ এই চারটে সিন তুলতেই হবে। ‘অ্যাডাপ্ট’ করতে না পারলে ‘সার্ভাইভ’ করতে পারবে না। আমি হিন্দি ছবিতে কাজ করে দেখেছি, সেখানেও কিন্তু আজ সময়ের অভাব।
প্রশ্ন: সেখানেও?
টোটা: হ্যাঁ, সেখানেও অভাব। কারণ, দিনের সংখ্যা তো কমে যাচ্ছে! এখানকার মত হচ্ছে না, যেহেতু বাজেটটা এখানকার থেকে বেশি তাই সময়টাও এখানকার থেকে বেশি পাচ্ছে। আমাদের এখানে একটা ছবিতে ঠিকঠাক করে সময় পাওয়া যায় ১৮ দিন। আমি নিজে আজ থেকে ১২-১৪ বছর আগে ছবি করেছি, অবশ্যই বড় ছবি, সেখানে আমি ৪০ দিন শুটিং করেছি। তাহলে, অর্ধেকের কম সময়ে চলে এসেছে! অনেকে সেই ১৮ দিনও পান না। অথচ মুম্বইতে আমি দেখেছি আগে গড়ে ৬০ দিন লাগত। এখন কিন্তু সেটাও নেমে ৪৫ দিনে চলে এসেছে।

প্রশ্ন: মানে আমাদের আগের জায়গাটায়…
টোটা: হ্যাঁ। কারণ ওদেরও ‘রিসোর্স’ আস্তে আস্তে কমছে। আর মানুষ ক’টা ছবি দেখবেন সেটাও তো ভাবতে হবে। শুধু দর্শকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। মানুষ কত ছবি দেখবে? আজকে হিন্দিতে ভাল, কম ভাল, খারাপ, ভীষণ খারাপ সমস্ত কিছু মিলিয়ে বছরে ২২০-২৫০ এর কাছাকাছি ছবি হয়। যদি তার চার ভাগের এক ভাগ ধরি, তাও ৫০-৬০টা ছবি। সেটা দেখার সময় তো মানুষের কাছে নেই। একটা মানুষ যদি খুব ছবি দেখতে ভালবাসেন, তাহলেও সে মাসে ক’টা ছবি হলে গিয়ে দেখবেন? দুটো! তাহলে তাঁরা বছরে ২৪টা ছবি দেখবেন।
প্রশ্ন: ঠিকই। পেশাগত কারণে দেখতে বাধ্য না হলে ওইরকমই দেখবেন খুব বেশি হলে।
টোটা: তাহলে তাঁরাও তো রিসোর্সটা ফিরে পাচ্ছে না! আর শুরু থেকে তো কেউ জানে না কোন ছবিটা লাগবে আর কোনটা লাগবে না। স্টার সিস্টেমও সেভাবে কাজ করছে না। স্যাটেলাইট রাইটস্ বা অন্যান্য বেশ কিছু ক্ষেত্রেও সেই ভাবে আর টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাঁরা কী করছে? একধার থেকে বাজেট কমিয়ে দিচ্ছে।
প্রশ্ন: এই জায়গাটাতে ঢুকতে চাইছিলাম। যেটা বললে, স্টার সিস্টেমও সেভাবে কাজ করছে না। সেই দিক থেকে দেখলে, এখন তো অভিনেতাদের সময়। এবার তুমি যদি নিজেকে ‘কোট আনকোট’ স্টার না ভাবো, তাহলে এখন তো তোমার মত অভিনেতার সময়?
টোটা: স্টারদের একটা ব্যাপার রয়েছে। খুব মজার। তাঁদের একটা অন্য ডাইমেনশন থাকে যেটা মানুষ ভালবাসে। কেন ভালবাসে সেটা কিন্তু তারাও অনেক সময় বলতে পারবে না! আমার ভাল লাগে, ব্যস। তাই স্টারদের একটা ‘ক্যাপটিভ অডিয়েন্স’ আছে। তবে আমার মনে হয়, যাঁরা অভিনেতা, এই সময়টা তাঁদের জন্য খুব ভাল। তাঁরা বিভিন্ন চরিত্রে বিভিন্ন ভাবে অভিনয় করার সুযোগ পাচ্ছেন।
প্রশ্ন: ওটিটির কল্যাণে তো বটেই…
টোটা: এবার ওটিটিও কিন্তু আস্তে আস্তে স্টার নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি মুম্বইয়ের দিকে দেখ, ৫-১০ বছর আগে যাঁরা স্টার ছিল, তাঁদের জন্য কিন্তু এখন ‘রেড কার্পেট’ বিছানো হচ্ছে। আর এইটা যাঁরা মূলত ওটিটি করেই নাম করেছেন তাঁদের কাছে কিন্তু বেশ উষ্মার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাঁরা ভাবছেন, আমরা প্ল্যাটফর্মটাকে দাঁড় করালাম আর আজ, এতদিন যাঁরা মিডিয়ামটাকে ব্রাত্য করে রাখল তাঁদের জন্য ‘রেড কার্পেট’ বিছিয়ে দিচ্ছ! আমাদেরকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছ না! আমি তাঁদের এই অভিযোগটা শুনেছি। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। কারণ, দিনের শেষে তো রায় দেবেন দর্শকরাই। আমরা ‘থিওরাইজ’ করতে পারি, তর্ক করতে করতে কাপের পর কাপ চা শেষ করে দিতে পারি, কিন্তু শেষমেশ দর্শক যেটা চাইবেন সেটাই হবে।

প্রশ্ন: আমরা এখন দেখছি অনেক ছবি রিলিজ করার পরে সেভাবে চলছে না কিন্তু পরবর্তীতে ওটিটিতে খুব ভাল চলছে। মানুষ বারবার দেখছেন। কোনও জায়গা থেকে কি আমাদের সঠিকভাবে টার্গেট অডিয়েন্স বাছাই করার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে?
টোটা: আমার মনে হয়, এখানে পরিচালক আর প্রযোজক দুজনেরই সাহস লাগবে। আমার ছবিটা ভাল লাগছে, আমি করব; এই মাইন্ডসেট দরকার। সেটা সব ধরণের ছবি। যা দরকার, আমি করব। চলুক, না চলুক না সেটা পরের ব্যাপার। ছবি চলা কপালের ব্যাপার এবং সময়ের ব্যাপার। আমি অনেক ছবি দেখেছি যা চলেনি, কিন্তু ভীষণ ভাল ছবি। আবার অনেক ছবি চলে, যেগুলো হয়ত ছবি হিসেবে খুব একটা উঁচু দরের নয়। আসলে দর্শক যেটা যখন দেখতে চাইবেন, দেখবেন।
প্রশ্ন: একদম ঠিক…
টোটা: তবে হ্যাঁ, আমরা একটা ইন্টারেস্টিং পজিশনেও পড়ে গেছি। একটা দিক, দর্শক কী চাইছে, সেটা ক্যাটার করতে হবে। আবার দর্শকের চাওয়াকে মাথায় রেখে চিত্রনাট্য সাজিয়ে যদি ছবি করতে যাও তাহলে কিন্তু না চলার সম্ভাবনা বেশি। যদি না বিরাট কোনও স্টার, দারুণ মিউজিক বা হাই-প্রডাকশন ভ্যালু থেকে থাকে। যেটার ট্রেলার দেখলেই মনে হবে, এটা আমাকে হলে গিয়ে দেখতেই হবে। কারণ, দর্শক নাহলে বলতে পারে, এটা তো আমি দেখেই নিয়েছি। নতুনত্ব কী আছে? আরেকটা হচ্ছে, ‘ওয়ার্ড অব্ মাউথ পাবলিসিটি’। আমি হয়ত ছবিটা দেখে কাউকে বলছি, দেখে আয়, খুব ভাল হয়েছে। মিস করিস না। এই সময়টা আবার আজ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন বেশিরভাগ প্লেক্সে যেটা হয়েছে, শুক্র-শনি-রবি এই তিনদিন ছবি যদি খুব ভাল পারফরম্যান্স না করে, তাহলে সোমবার থেকে শো কমিয়ে দেব আর তার পরের সপ্তাহ থেকে উঠিয়ে দেব।
প্রশ্ন: আর শো কমিয়ে দেওয়ার পরে এমন উদ্ভট শো টাইম দেওয়া হবে যে মানুষ এমনিই ছবি দেখতে যাবে না।
টোটা: হ্যাঁ, একদম। মানুষ যাবে না। আর কিছু করারও নেই। এটা তাদেরও তো ব্যবসা! এটা তাঁরা নিছকই ব্যবসা হিসেবে করছে। এ তো কোনও সোশ্যাল সার্ভিস নয়! কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটা প্লেক্স তৈরি করতে হয়। সে তো চাইবেই যে তাঁর ব্যবসা হোক। সেখানে ওঁরা বলছেন, তিন দিনের মধ্যে তুমি যদি ব্যবসা করতে না পারো তারপরেও আর ব্যবসা হবে না। সেই জন্য ছবিটার ‘ওয়ার্ড অব্ মাউথ পাবলিসিটি’ হচ্ছে না।
প্রশ্ন: সময়টাই তো পাচ্ছে না!
টোটা: হ্যাঁ। আরেকটা যেটা হচ্ছে, সিঙ্গল স্ক্রিন কমে গেছে। যে সময় আমরা কাজ করেছি, যে সময় বাংলা ছবির রমরমা, প্রায় ৭৫০ এর বেশি সিঙ্গল স্ক্রিন ছিল। প্লেক্স তো এল ২০০০-এর দশকে। প্লেক্সের প্রথম বাংলা ছবি ‘চোখের বালি’। তার আগে যা যা ছবি চলেছে, সবই সিঙ্গল স্ক্রিনে। অ্যাওয়ার্ড উইনিং ছবিও। ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘বাড়িওয়ালি’, ‘পারমিতার একদিন’, ‘শ্বেত পাথরের থালা’, সব সিঙ্গল স্ক্রিনে চলেছে। মানুষ কিন্তু সেইখানে দেখতেও গিয়েছিলেন। আজ সেখানে স্ক্রিন কমতে কমতে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, কমার্শিয়াল ছবির বাজারটা প্রায় শেষ! সাউথে কিন্তু তা নয়। তারা ধারাটা বজায় রেখেছে।
প্রশ্ন: সাউথের মানুষ ‘রিলিজিয়াসলি’ ছবি দেখে। তারা ভোরবেলার শোতেও সিনেমা দেখতে যায়।
টোটা: হ্যাঁ। তাদের সেই উন্মাদনাটা আছে। তারা সিঙ্গল স্ক্রিন শুধুমাত্র রাখেনি, সুন্দর ভাবে রেখেছে। আমার মনে আছে, ২০০৭ সালের দিকের কথা। চেন্নাইতে শুটিং করতে গেছি। তখন ওঁদের এক পপুলার স্টার বিক্রমের একটা ছবি রিলিজ হয়েছে। আমি বললাম, আমি সিঙ্গল স্ক্রিনে ছবিটা দেখব। হলটা অন্যান্য অনেক হলের থেকে একটু ছোট। ছোট মানেও ৫০০ সিট। যেটা আজকের প্লেক্সের দুটো শোয়ের থেকেও বেশি। ছবিটা কিন্তু আমি দেখতে গেছি পঞ্চম সপ্তাহে। সেদিন আমার অফ, আমি ম্যাটিনি শো দেখতে গিয়েছিলাম। ওরা কিন্তু এখনও ১২টা-৩টে, ৩টে-৬টা, ৬টা-৯টা, ৯টা-১২টা ফলো করে। আমি ম্যাটিনি শো ৩টে-৬টা দেখতে গেছি। দেখলাম হল কানায় কানায় পূর্ণ। লক্ষ্য করলাম, প্রত্যেকটা সিট গদি দেওয়া এবং পুশ-ব্যাক। কার্পেট পাতা ফ্লোর, ঝকঝকে স্ক্রিন। স্ক্রিনটা যে ১৫দিনে বা মাসে অন্তত একবার ধোয়া হয়, সেটা পরিষ্কার। সাউন্ড সিস্টেম ভাল। ওয়াশরুমগুলো পরিষ্কার।

প্রশ্ন: মানে যেটা লাগে আর কি!
টোটা: হ্যাঁ! সেই কারণে লোকে যাচ্ছে। আমি একটা ছবি দেখতে যাচ্ছি। যেটার জন্য যাওয়া, সেই স্ক্রিনটাই যদি ঠিক না থাকে, সাউন্ড যদি ঠিক না থাকে, তাহলে কেন দেখতে যাব আমি ছবিটা? কেউ তো আমাকে মাথা দিব্যি দেয়নি! এখন তো আরও দেখবে না। কারণ অনেক ভাল রেজল্যুশনের একটা স্ক্রিন তার পকেটে আছে। সেটাই সে দেখবে। কয়েক লক্ষ সিনেমা তার হাতের মুঠোয় আছে!
প্রশ্ন: চাইলে সে তার স্মার্ট টিভিতেও সেটা দেখছে…
টোটা: আমি সেটাও বাদ দিচ্ছি। আমি ধরে নিলাম, একদম সাধারণ একজন মানুষ। তার কাছে স্মার্ট টিভি নেই। কিন্তু মোবাইলটা আছে। এবার তুমি বলতে পার, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটছে। কিন্তু, মিটছে তো? তার তেষ্টাটা তো মিটছে!
প্রশ্ন: সম্প্রতি আমাকে মুম্বইয়ে একজন ফিল্ম ক্রিটিক বললেন, অনেকক্ষেত্রে হলে না দেখা একটা বাংলা ছবি ওটিটিতে দেখতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পরে মানুষ স্কিপ করছেন। তাঁরা ভাবছেন, ভাগ্যিস হলে দেখতে যাইনি! এবং এটা তিনি অনেক বাঙ্গালীর থেকেই নাকি শুনেছেন! এরকম জায়গাই আমরা তৈরি করেছি?
টোটা: এতে আমি একদমই একমত নই। মুম্বইতে কী হচ্ছে? মুম্বইতে কয়েকজন এইটা বলতে ভালবাসে। এটা হচ্ছে কোটিতে গুটি। তুমি আমাকে বল তো ক’টা হিন্দি ছবি এরকম হয়েছে যেটা ওটিটিতে রিলিজ করার পরে লোকে বলেছে, আহা, এটা আমি হলে গিয়ে দেখলাম না! ওদের বেশিরভাগ ছবি দেখেও কিন্তু লোকে বলে, দেখেছ, ভাগ্যিস হলে যাইনি! আসলে মানুষকে হলে টানা এখন খুব মুশকিল হয়ে গেছে। সেটা যে কোনও ভাষাতেই। সাউথের তো একটা হেরিটেজ রয়েছে হলে গিয়ে ছবি দেখার। একটা কালচার রয়েছে। ওখানে ছবি ফ্লপ হয় না? সুপার ডুপার ফ্লপ হয়। কন্নড় ইন্ডাস্ট্রিতে যখন কাজ করতে গিয়েছিলাম, ওঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমরা বছরে ক’টা ছবি কর? ওঁরা বলেছিল, ২০০-২২০ টা। আমি ক’টা চলে জানতে চাইতে বলল, খুব বেশি হলে ১০-১২টা। এবার তুমি আমাকে বল, আমরা ক’টা ছবি করছি পোস্ট কোভিড?
প্রশ্ন: এই বছরে ৮৬টা মত।
টোটা: আমাদেরও ৮-১০টা ছবি চলছে। রেশিও যদি দেখ, আমরা বেটার পজিশনে আছি। তুমি হিন্দি আর বাংলার রেশিওটা খেয়াল করবে। প্রডাকশন কস্ট, বক্স অফিস রিটার্ন, ছবির সংখ্যা, ক’টা ছবি চলছে তার রেশিও তৈরি করলে বাংলা ছবি যথেষ্ট উঁচুতে আছে। এটা আমরা বাঙালিরা রিয়েলাইজ করছি না। সমস্যাটা হচ্ছে, আমরা ধরেই নিয়েছি যে, বাঙালি মানেই আমাদের সবকিছু বোধহয় চলে যাচ্ছে। তাই বাঙালি নিজেই বিশ্বাস করছে না! আরে বাবা, বাঙালির তো একটা পরম্পরা, বুদ্ধি, লজিক্যাল সেন্স আছে। সেই লজিকটা তো আমরা ব্যবহার করছি না! আজকাল কিন্তু ‘ডেটা’ পাওয়া মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়।
প্রশ্ন: ঠিকই। মোবাইল থেকেই পাওয়া যায় সব।
টোটা: আমরা কয়েকশ’ রিল দেখছি, তার জন্য হাতে সময় আছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই বাংলা ছবির দুর্দশা নাকি সুসময়, তার একটা তুলনামূলক ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ তো করছি না! এই যে একটা ন্যারেটিভ, আমি জানি না কারা তৈরি করছে কিন্তু তৈরি হচ্ছে। এটা কিন্তু খুব মারাত্মক। এখানে কিন্তু প্রত্যেক বাঙালি যদি নাও পারে, অন্তত আমরা যাঁরা ইন্ডাস্ট্রির অংশ, তাঁদের উচিত ‘ফ্যাক্ট’সহ এই কুৎসার বিরোধিতা করা। আমি শুকনো প্রতিবাদে বিশ্বাসী নই। ‘ফ্যাক্ট’ নিয়ে কথা হবে। কোন ইন্ডাস্ট্রিকে বলছ এগিয়ে আছে? সেই ইন্ডাস্ট্রির আর বাংলা ইন্ডাস্ট্রির রেশিও টানো, তারপরে নিজে বিচার কর। হাতে তো ক্যালকুলেটর আছে। আজকে তো মোবাইলেও ক্যালকুলেটর আছে। হিসেব করে দেখ। বাংলাতে যথেষ্ট ছবি চলছে। আমরা যে পরিমাণে ছবি তৈরি করি, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ঠিকই চলছে। সারা পৃথিবী এমনকী হলিউডেও যদি ১০% ছবি পজিটিভ জায়গায় থাকে, তারা বলে ‘ইটস্ আ গুড ডিল’। আমরা কিন্তু ১০%-এর উপরেই আছি।
প্রশ্ন: তাহলে তুমি বলছ আমরা পজিটিভ জায়গাতেই আছি, আমাদের শুধু সেটা ‘মেনটেইন’ করার প্রয়োজনীয়তা আছে?
টোটা: অবশ্যই পজিটিভ জায়গায় আছি। একটা বিষয় মানুষ লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, এবার পুজোতে তিনটে ছবি রিলিজ করেছে। ‘টেক্কা’, ‘বহুরূপী’ আর ‘শাস্ত্রী’। তার এক সপ্তাহ পরে বড় হাউসের এবং বড় স্টারের দুটো হিন্দি ছবি রিলিজ করেছে। তিনটে বাংলা ছবির শো কমে গেল। শুক্র-শনি-রবি হলমালিকরা দেখল যে ওই দুটো ছবির থেকে তিনটে বাংলা ছবির ডিমান্ড অনেক বেশি। ওদেরকে বলা হল, পাততাড়ি গোটাও আর হল ছাড়ো। আবার বাংলা ছবির শো বাড়ল! এই যে প্রতিরোধ, আমি আশা করেছিলাম মিডিয়া বা দর্শক এটা অনেক বড় করে সেলিব্রেট করবে। কিন্তু কোথাও যেন আমরা সেটাকে কার্পেটের তলায় ঝাঁট দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম। এটা সেলিব্রেট করতে দেখলাম না যে, বাংলা ছবি এবারে পাল্টা দিচ্ছে আমাদের কাজটা ভাল হচ্ছে বলে। এটা তো আমাদের মধ্যে পজিটিভিটি ভরে দেওয়া উচিত ছিল যে, দেখ আমরা পেরেছি। এরপরে আরও ভাল ভাল ছবি বানাব, সবাই মিলে বানাব। এই পজিটিভিটি, উৎসাহ, উদ্দীপনা তো এখান থেকে আমাদের আহরণ করা উচিত ছিল!
প্রশ্ন: হ্যাঁ, সত্যি এবার এটা পুজোয় হয়েছে।
টোটা: তাহলে, হয়েছে তো? এটা ফ্যাক্ট। অংক ছাড়া আমি কিচ্ছু বুঝি না। আর এই যে দুর্নাম, বাঙালি হলে যায় না। অংক বলছে, যায়। ছবি ঠিকঠাক পেলে সে ঠিকই হলে যাবে। এখন চারদিকে একটা নেগেটিভিটি। বাংলায় কিচ্ছু হচ্ছে না, বাংলা ছবি চলছে না, বাংলা ওটিটি চলছে না। এই নেগেটিভিটিটা কারা ছড়াচ্ছে? অংক তো অন্য কথা বলছে ভাই? তাহলে এই মিথ্যেটা ছড়ানো হচ্ছে কেন? অন্য উদ্দেশ্য আছে? নাকি কেউ খোঁচা দিচ্ছে মিথ্যে বলবার জন্য? এবার তো আমি প্রশ্ন করতে পারি?
প্রশ্ন: আজ এই ওটিটির যুগে দাঁড়িয়ে অনেক অভিনেতা যেমন পরিচালনায় আসছেন, তুমিও কি আবার পরিচালনার কথা ভাববে?
টোটা: আমি খুব নিরপেক্ষভাবে নিজের বিচার করেছি। আমি একটা ছবি পরিচালনা করেছি। আমি দেখলাম, পরিচালনা করার গুণ আমার মধ্যে নেই। পরিচালনার মধ্যে অভিনেতাদের হ্যান্ডলিং ব্যাপারটা আমি খুব ভাল পারি। আমি নিজে যেহেতু একজন অভিনেতা। আমি তাঁদের সঙ্গেই কাজ করেছিলাম, যাঁদের সঙ্গে বহুদিন কাজ করেছি। তাই তাঁদের জোরের জায়গাগুলো আমি জানি। সেটাকে আমি হ্যান্ডল করেছি। সেটা আমি খুব ভাল পারি। এর বাইরে আমার আর পরিচালনা করার কোনও গুণ নেই। এটা আমার উপলব্ধি। কাজেই ওই পথে আমি আর হাঁটব না। যেখানে আমি ১০০র মধ্যে ৬০ নম্বরও পাব না, সেই পথে আমি আর চলব না। আমি সেই পথেই চলব যেখানে আমি জানি যে ৬০-৭০ কি একটু চেষ্টা করলে ৮০ পেতেও পারি। ভাগ্য সহায় থাকলে হয়ত ৯০ পেতে পারি। আমি সেই পথেই চলব। পরিচালনা খুবই ‘স্পেশালাইজড’ একটা বিষয়, এটা আমার বিষয় নয়। আমি একজন ‘ডিপেন্ডেবল’ অভিনেতা হতে পারি, একজন ভাল অভিনেতাও হতে পারি। এই পর্যন্তই। তার বেশি কিছু আমি আর পারি না।

প্রশ্ন: বড়পর্দা, ওটিটি আর টেলিভিশন। তিনটে মিডিয়ামেই তোমার করা এমন কিছু চরিত্র রয়েছে যা নিয়ে মানুষ কথা বলেন। টেলিভিশনে প্রথমেই আসবে রোহিত সেনের কথা। আমি এমন অনেক মানুষকে জানি যাঁরা পারলে রোহিত সেনকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে যান! অনেকে আছেন আমার পরিচিত, যাঁরা রোহিত সেনের ছবি কেটে কাছে রেখে দিয়েছেন! বড়পর্দায় করণ জোহরের ছবিতে এমন অভিনয় করে এলে যে সারা ভারতবর্ষের চর্চার বিষয় হলে। যদিও বা আগেও তুমি সফল সর্বভারতীয় ছবি করেছ। আর ওটিটিতে ‘ফেলুদা আবার কবে আসবে’ কমেন্ট সৃজিতের পোস্টে চোখ রাখলেলে মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। তুমি কি তিনটে মিডিয়ামেই অ্যাক্টিভ থাকতে চাও নাকি টেলিভিশন থেকে কিছুদিনের জন্য আবার দূরে থাকবে?
টোটা: না, আমি তিনটেই করতে চাই। তবে টেলিভিশনের ক্ষেত্রে একটা জিনিস বলতে পারি, যেদিন আমি বুঝব আমি আগামী ১২ মাসে, মাসে অন্তত ১৫টা দিন করে টেলিভিশনকে দিতে পারব…আমি সেই দিনই আবার টেলিভিশনে ফিরব। আমার কোনও রকম ছুতমার্গ নেই। এখন হঠাৎ করেই তৈরি করা হয়েছে যে উপরের তলায় সিনেমা, তারপরে ওটিটি আর তারপরে টেলিভিশন। আমি এর গুরুতর বিরোধী। টেলিভিশনে আমি যে ভালবাসা পেয়েছি, যা ‘রিচ’ পেয়েছি, যা ফিডব্যাক পেয়েছি, অন্য দুটো মিডিয়ামে সেটা পাইনি। সত্যিই পাইনি। আজ এটা কিন্তু আর লোকাল নয়, টেলিভিশনও কিন্তু ইন্টারন্যাশনালি পৌঁছে যায় ওটিটির মত। সিনেমা এবং ওটিটির তুলনায় টেলিভিশন হচ্ছে অ্যানাকোন্ডার মত। জঙ্গলে সবথেকে বড় সাপ কিন্তু অ্যানাকোন্ডা। সে চাইলে ৪টে অজগরকে গিলে নিতে পারে, ৪০০টা গোখরোকে গিলে নিতে পারে। সমস্যাটা হচ্ছে, সে গিলতে চায় না বা নিজের সেই বিশ্বাসটুকু নেই।
প্রশ্ন: অনেকটা হাতির মত…
টোটা: হ্যাঁ। নিশ্চুপ। সে নিজে জানে না তার কতটা শক্তি। যেদিন বুঝবে, সেদিন কিন্তু সে সবাইকে গিলে নিতে পারবে। এটাই টেলিভিশন। আবার বলছি, বাংলার সবথেকে ট্যালেন্টেড অভিনেতারা টেলিভিশনে আছে। মুশকিল হচ্ছে, আমরা তাঁদেরকে খুঁজে বার করতে পারছি না। আমি মাঝে মাঝে কয়েকটা চ্যানেল সার্ফ করি। আমার মা, শাশুড়ি মা দেখেন। তাঁদের সঙ্গে বসে যখন গল্প করি, আমিও দেখি। ‘দে আর সাচ্ গুড অ্যাক্টরস্’। তারা দেখতে ভাল, ভাল অভিনয় করছে, স্ক্রিন পার্সোনালিটি ভাল। এরা কিন্তু একটা সময়ের পরে গিয়ে বাংলা ছবির ‘ডিপেন্ডেবল’ অভিনেতা হতেই পারেন! কিন্তু ওই একটা স্টিগমা তৈরি হয়েছে। এটা কেন?
প্রশ্ন: সেটা ঠিক। একজন অভিনেতা যিনি ভাল অভিনয় করেন, তিনি ভাল অভিনয়ই করেন।
টোটা: আজকে যে ব্রায়ান ক্র্যানস্টনকে (Bryan Cranston) নিয়ে এত মাতামাতি, ‘ব্রেকিং ব্যাড’ কী? একটা টিভি সিরিজ। ‘ফ্রেন্ডস্’, সর্বকালের সবচেয়ে সফল একটা প্রডাকশন। সেটা কী? টিভি সিরিজ।
প্রশ্ন: আমরা এখনও ইউটিউবে খুঁজে দেখি…
টোটা: …এবং বারংবার! এমনই তার ডিমান্ড যে প্রত্যেকটা ওটিটি প্লাটফর্ম চায় ‘ফ্রেন্ডস্’-এর সাথে যেন তার সিন্ডিকেশনটা থাকে। এগুলো কী? টিভি সিরিজ। তাই এই প্রভেদ সবার আগে বন্ধ হওয়া উচিৎ। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে যদি আমরা রেভিনিউর নিরিখে দেখি, তাহলে টেলিভিশন সবথেকে বেশি রেভিনিউ দেয়।
প্রশ্ন: অনেক অভিনেতাই এখানে কাজ করছেন এবং মাসের শেষে একটা স্যালারি পাচ্ছেন। সেটা সিনেমা বা ওটিটিতে সম্ভব নয়।
টোটা: কারণ, এটা একটা পেশা। আমি কতদিন একটা ভাল কাজের জন্য ধৈর্য ধরে বসে থাকব? আমি ভাল কাজটাই টেলিভিশনে করব। হ্যাঁ, অনেক সময়ই টেলিভিশনে চটজলদি কাজ করতে হয়, সেই সময়টা পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন: সেই দিক থেকে দেখলে তারা আরও ভাল অভিনেতা!
টোটা: একদম ঠিক বলেছ। একবার পড়ে, সেটা মুখস্থ করে, শুধু মুখস্থ নয়, আত্মস্থ করে অভিনয় করা এবং সেই অভিনয়টা করে লাখ লাখ দর্শককে বসিয়ে রাখা, সেটা ভাল অভিনয় নয়? আমি তো বলব দুর্ধর্ষ অভিনয়। এবং সেটা সন্ধের পর সন্ধে। তাই প্রভেদগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। আমি তো চারটে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করলাম, তার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সব থেকে ট্যালেন্টেড অভিনেতা অভিনেত্রীরা কিন্তু বাংলাতেই আছে। ট্যালেন্ট বা পারফরম্যান্সের দিক থেকে তারা কয়েক যোজন এগিয়ে। আমাদের আত্মবিশ্বাসটা কম। আমরা ধরেই নিয়েছি, না না, ওরা ভাল। একেবারেই নয়। আমি এক বছর আগেও ‘প্রেডিক্ট’ করেছিলাম, আজ আবার বলছি, আগামী পাঁচ বছরে হিন্দি ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের বাংলার কতজন ছেলেমেয়ে যে কাজ করবে, তুমি দেখে নিও। তারা এখন বুঝতে পেরে গেছে যে আমরা এখানে কী স্পিডে কাজ করি এবং কতটা ট্যালেন্ট আছে।
প্রশ্ন: প্রচুর টেকনিশিয়ানও বাংলা থেকে আছেন, যাঁরা মুম্বইতে প্রতিনিয়ত কাজ করেন।
টোটা: ক্যামেরা ডিপার্টমেন্ট আর মিউজিকে তো প্র্যাকটিক্যালি বাঙালিরাই! ড্রেস, সেট এমনকী যদি ক্যাটারিংয়েও দেখি, কতজন যে মেদিনীপুরের ছেলে ওখানে আছে! আমি ওদের বলি, তোমরা তো পুরো ডিস্ট্রিক্ট ঝেঁটিয়ে এখানে এসেছ! বিভিন্ন ইউনিটে আমি নিজে দেখেছি। হঠাৎ করে কেউ, ‘টোটাদা’ বলে ডাকল। এবার ওখানকার লোকজন অবাক হয়ে যায়। ভাবে কী করে চিনল! আমি যে এত বছর ধরে কমার্শিয়াল ছবি করেছি, টেলিভিশন করেছি, ওরা তো আমাকে দেখেছে। হঠাৎ যখন ওরা ওখানে দেখে, জিজ্ঞাসা করে, “দাদা আপনি এখানে! কী ব্যাপার?” আমিও ওদের জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কোথায় থাকো?

প্রশ্ন: আবার ‘চালচিত্র’ ছবিতে ফিরি। অনেকে বলেন, ‘সত্যজিৎ রায় স্কুলিং’, ‘মৃণাল সেন স্কুলিং’। সেভাবেই হয়ত আমরা বলতে পারি ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ স্কুলিং’। এই যে রাইমা’র সঙ্গে আবার এতদিন পরে কাজ। ঋতুপর্ণ ঘোষের স্কুলিংটা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া গেল? বাঙালি বুঝে গেছে ঋতুপর্ণ ঘোষের কিছু একটা আলাদা ম্যাজিক ছিল। কিন্তু কী আলাদা ছিল? তোমরা যখন একসাথে কাজ কর, এমন কোনও কেমিস্ট্রি কাজ করে, যেটা হয়ত আলাদা কিন্তু কী আলাদা তোমরা নিজেরাও বুঝতে পার না?
টোটা: রাইমা’র সঙ্গে ‘চোখের বালি’, তারপর ‘সানগ্লাস’।
প্রশ্ন: সেটা রিলিজও হল না!
টোটা: হ্যাঁ, খুবই দুর্ভাগ্যজনক। রাইমা তখন সদ্য উঠছে, আমিও একটা বড় ছবিতে ব্রেক পেয়েছি। একটা বন্ডিং তৈরি হয়েই গিয়েছিল। ঋতুদার স্কুলিংটা এই, ঋতুদা মানুষকে খুব কনফিডেন্স দিত। যদি দেখত যে খুব খাটছে, চেষ্টা করছে, তাকে কনফিডেন্স দিত। আবার ‘ওভার কনফিডেন্ট’ যারা, তাদেরকে ঠিক তাদের জায়গায় নামিয়ে নিত। ঋতুদার এই গুণটা ছিল। ঋতুদাই আমাকে প্রথম বলেছিল, “সব সময় জিজ্ঞাসা করছিস কেন ভাল হয়েছে কিনা? যথেষ্ট ভাল কাজ করছিস। তুই ভাল কাজ করিস। তুই ভাল অ্যাক্টর। ডোন্ট লেট এনিবডি সে আদারওয়াইজ। ইউ আর আ ডিপেন্ডেবল অ্যাক্টর”। তার আগে কিন্তু কেউ বলেনি। আগে শুনেছি, দেখতে মন্দ নয়, ডান্স পারে, ফাইট পারে ফিজিকটা ভাল, কিন্তু অ্যাক্টিংটা ঠিক সেরকম নয়। এটা মুখের উপরেই বলতেন কয়েকজন দাদা স্থানীয় লোক। ঋতুদা প্রথম বলেছিলেন, “একদম বিশ্বাস করবি না। তোর কনফিডেন্সটা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তুই অনেক ভাল অ্যাক্টর”। আর রাইমা’কে তো নিজের মেয়ের মত ভালোবাসত। আমরা তো বলতাম, বাহ্ কি সুন্দর বৈষম্য মূলক আচরণ হচ্ছে, সুচিত্রা সেনের নাতনি বলে। ঋতুদা বলত, “তোদেরকেও আমি যথেষ্ট ভালবাসি। তোদের জন্যও যথেষ্ট করি।” খুব মজার সময় আমরা কাটিয়েছি। আসলে ‘চোখের বালি’ ছিল ঋতুদার কাছে যাকে বলে…
প্রশ্ন: ম্যাগনাম ওপাস!
টোটা: হ্যাঁ, ‘চোখের বালি’ ঋতুদার ম্যাগনাম ওপাস। একবার বলেছিল, “আমি যেদিন ঠিক করলাম যে ছবি পরিচালনায় আসব, সেদিনই ঠিক করে রেখেছিলাম যে যদি কখনও সুযোগ পাই তাহলে আমি ‘চোখের বালি’ করব।”
প্রশ্ন: একজন অভিনেতা যে ছবিই করেন, সেখান থেকে কিছু না কিছু নিয়ে ফেরেন। ‘চালচিত্র’ থেকে তুমি কী নিয়ে ফিরলে?
টোটা: ঠিক। ‘চালচিত্র’ থেকে খুব সুন্দর একটা বন্ডিং নিয়ে ফিরেছি। আমরা যাঁরা কাজ করছিলাম, অনির্বাণ চক্রবর্তীর সঙ্গে তো একাধিক কাজ আগেও হয়েছে। শান্তনুর সাথে প্রথম কাজ করলাম। ইন্দ্রজিত, অপূর্ব। অপূর্ব, শান্তনু এত বড় স্টার আর কী ভাল মনের মানুষ! অসম্ভব ভাল কাজ করেছে আর কত সুন্দর ভাবে কাজ করেছে। রাইমা তো আছেই। মানে যাঁদের সঙ্গে আমি স্ক্রিন শেয়ার করেছি, তাঁদের কথা বলছি। এছাড়া অনিন্দিতা, স্বস্তিকা, প্রিয়া আছে, এঁদের সঙ্গে কাজ করে খুব সুন্দর একটা বন্ডিং তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে আমরা চারজন যাঁরা পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছি। এছাড়া প্রতিম আর আমার প্রযোজক হাসান, এরা তো বন্ধুস্থানীয়। তাই এঁদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাটা খুব মজার হয়েছে। আসলে কী হয় জানো তো, কাজটা আগে হয়। যেটা আমাদের প্রফেশন। সবসময় যে আনন্দ ফুর্তি হবে তা তো নয়, সেটা অনেক সময়ই হয় না। কিন্তু যখন হয়, সেটা আমাদের উপরি পাওনা হয়। যেটা এখানে আমি পেয়েছি। কিছু কিছু কাজ আছে, যেটা করে শেষ দিনে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ‘চালচিত্র’ সেরকম একটা কাজ। শেষ দিনে মনে হয়েছে, আর দু-তিনটে দিন যদি শুটিং হত, তাহলে ভাল হত।
প্রশ্ন: তুমি অনেক বই পড়ো। তুমি নিয়মিত শরীরচর্চা করো। সব মিলিয়ে তুমি একজন গোছানো মানুষ। টোটা রায়চৌধুরী নিজের ঘর সাজানোর ব্যাপারটা নিজেই ঠিক করে নাকি সেটা বাড়ির লোকেদের উপরেই সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়?
টোটা: আমার যে স্পেসটা আছে সেখানটা কেমন সাজানো হবে সেটা আমিই ঠিক করি। আমার স্পেসটা খুব ছোট। আমি সব জায়গায় নিজের একটা ছোট্ট স্পেস তৈরি করি। সেটা একান্তভাবে আমার। এইখানে আমি কারও কথা শুনব না। বাড়ির মধ্যে হোক, আমার কাজ হোক বা আমার জীবনধারাই হোক, ওই ছোট্ট যে জায়গাটা, সেটা শুধুই আমার।
প্রশ্ন: মানে সেই স্পেসটা যদি একটা ছোট ঘর হয়, তাহলে তার ইন্টিরিয়র তোমার?
টোটা: খুব সাজানো-গোছানো নয় কিন্তু একদম পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। সাজগোজ সাধারণ হলেও চলবে কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লাগবে। আমি ধুলো, নোংরা, ছড়ানো ছেটানো একেবারে পছন্দ করি না। শ্রী-হীন ব্যাপারটা আমার একদম ভাল লাগে না। একটা ডিসিপ্লিন থাকা উচিত। অনেকে বলে আমার এমন একটা ওসিডি, আমি মনে করি না সেটা। আমি যখন শুটিং করছি সোনমার্গে, আমার কল টাইম ছিল সকাল ছ’টায়। কারণ সেই দিন শুট করে রাতে বেরোনো। ভোরবেলা তখন প্রায় মাইনাস ৮-৯ ডিগ্রি। আমি কিন্তু স্নান করেছি।
প্রশ্ন: সে কী!
টোটা: স্নান করে, কাঁপুনি কাকে বলে! তবু আমার সব সময় মনে হয়েছে, স্নান করেই কাজ করতে যাব।
প্রশ্ন: এটা তো অনেকটা পুজো করতে যাবার মত?
টোটা: হ্যাঁ, আমার কাজটাই আমার পুজো। কাজ হচ্ছে আমার কাছে ঈশ্বরের উপাসনা। আমি কাজের মধ্যেই খুঁজে পাই ঈশ্বরকে। ওই ঠান্ডায় স্নান করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, কস্টিউম পরে আমি বেরোলাম। এইসব ক্ষেত্রে আমি আদারওয়াইজ কিছু পছন্দ করি না। ঠিক যেমন আমার বইয়ের জায়গায় বই থাকবে, কাপটা যেখানে থাকার সেখানেই থাকবে, সেরকমই।
প্রশ্ন: বইয়ের কথা উঠল, জিজ্ঞাসা করি। যদি কোনও আউটডোর শুটে যাওয়ার সময় বলা হয় যে তুমি পাঁচজন লেখকের বই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে, কী কী নেবে?
টোটা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, জন গ্রিসাম আর উইলবার স্মিথ। এই পাঁচজন আমার ফেভারিট। এঁদের লেখা আমার ভীষণ ভাল লাগে। মনে হয় বিভিন্ন বিষয়ে লেখায় এঁরা এত দক্ষ! বিশেষ করে সুনীল বাবু, সঞ্জীব বাবু, শীর্ষেন্দু বাবুর ভাষার উপরে যে দখল, খুব গুঢ়তত্ত্ব এত প্রাঞ্জল ভাষায়, সুন্দর করে বিশ্লেষণ করে পরিবেশন করেছেন, সেটা শিক্ষণীয়। যেমন জন গ্রিসামকে আমার ভাল লাগে ওঁর কোয়ালিটির জন্য। সম্প্রতি একটা বই পড়ছিলাম, আমেরিকায় দশটা কেসে ভুল ভার্ডিক্ট দেওয়া হয়েছিল। সেই কেসগুলোকে নিয়ে লিখেছেন। নন-ফিকশন যে এত উপাদেয় হতে পারে, সেটা আমি জানতাম না।
প্রশ্ন: আমি আবার নন-ফিকশন পড়তেই ভালবাসি।
টোটা: আসলে ফিকশন হচ্ছে ‘ক্রিয়েটেড ওয়র্ল্ড’, সিনেমার মত। আর নন-ফিকশন হচ্ছে রিয়্যালিটি। এবার রিয়্যালিটি সবসময় খুব উপাদেয় হয় না।
প্রশ্ন: ডিস্টার্বিং হয়…
টোটা: হ্যাঁ, ডিস্টার্বিং হয় বা কাঠখোট্টা হয়। সব দিক থেকেই। আসলে একটা হচ্ছে ফ্যাক্ট আরেকটা হচ্ছে ক্রিয়েটেড ফ্যাক্ট। আমি অনেকটা ক্রিয়েটেড ফ্যাক্টে বিশ্বাস করি। কাঠখোট্টা সত্যটাকেই তুমি যদি একটুখানি ড্রেসিং করে, আরও প্যালেটেবল্ করে আমার কাছে পরিবেশন কর, সেটা আমার কাছে বেশি আকর্ষণের।